গতকাল ছিল ঐতিহাসিক ১০ এপ্রিল, প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠন দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় গঠিত হয় এই সরকার। ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানী বর্বর হানাদার বাহিনী। সারাদেশে তান্ডব সৃষ্টির মাধ্যমে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে তারা। দলে দলে লোক পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন প্রবাসী সরকার গঠনের। লক্ষ্য দেশকে হানাদারমুক্ত করা, বাঙালীর স্বাধীনতা নির্বিঘ্ন করা। সিদ্ধান্ত হয় ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (পরে মুজিবনগর) প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ ও আনুষ্ঠানিক যাত্রার। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৭ এপ্রিলের শপথের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ ও প্রস্তুতি নেয়া হয়। ১৩ এপ্রিল ৬ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম এবং মন্ত্রীদের মাঝে দফতর বণ্টন করা হয়। ১৪ এপ্রিল কর্নেল এমএজি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সরকার গঠনের পর শপথ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা পাই ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস। বাঙালী জাতির ইতিহাসের এক মহত্তম দিন এটি। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের সীমান্ত লাগোয়া বৈদ্যনাথতলার এক বিশাল ছায়াঘেরা আমবাগানে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের আয়োজন করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে প্রবাসী বিপ্লবী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং মন্ত্রী হিসেবে এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান প্রমুখ শপথ নেন। এই সরকারের নেতৃত্বে নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে। রাজনৈতিক কর্মকান্ড, কূটনৈতিক ও প্রচার ক্ষেত্রে বিশ্ব জনমত গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল সেদিনের অস্থায়ী সরকার। এই সরকারের দক্ষতার ফলেই মাত্র নয় মাসে বাংলাদেশ হানাদার পাকিস্তানীদের দখলমুক্ত হয়েছিল। তাই ১০ এপ্রিল সরকার গঠন ছিল অত্যন্ত দূরদর্শী ও সফল সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। এর রয়েছে দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের ধারাবাহিকতা; বহু ত্যাগ ও তিতিক্ষা এবং রক্তপাত। এই দীর্ঘ প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজন ছিল অবিচল রাজনৈতিক নেতৃত্ব। সেই সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধের নয় মাস তিনি সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও ছিলেন সাড়ে সাত কোটি মানুষের সত্তায়, ছিলেন সকল কিছুর মূল চালিকাশক্তিস্বরূপ। সেই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয় ১০ এবং ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে, যেখানে তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে নেতৃত্বে রেখে গঠিত হয় বিপ্লবী সরকার। শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ধারণ করেই সেই সরকার হয় মুজিবনগর সরকার। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এই সরকার গঠন দিবস পালিত হচ্ছে নতুন আলোকে, নতুন প্রজন্মের চেতনাকে শাণিত করার লক্ষ্য নিয়ে। এদিন জাতি স্মরণ করে তাঁর মহান নেতাদের, যাঁদের শ্রমে, কর্মে, নিষ্ঠায় বাঙালী পেয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম স্বদেশ। তাই ১০ এপ্রিল ইতিহাসে চির স্মরণীয়, চির অমলিন একটি দিন। ইতিহাসের আলোকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকসহ বিশ্বের বহু দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে। বিশ্বব্যাংকের ভাষায় বাংলাদেশ আজ ‘বিশ্ব নেতা’।
Leave a Reply